সীমাহীন আকাশে ওড়ার স্বপ্ন তাড়া করেছিল পাইলট তৌকির ইসলাম সাগরকে। সেই স্বপ্ন হাতের মুঠোয় আসার পর নিজেই হারিয়ে গেলেন। প্রশিক্ষণের শেষধাপে সফলভাবে বিমান নিয়ে উড়াল দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আর ফিরলেন না বাবা-মার বুকে। বিদায় না নিয়েই চিরতরে চলে গেলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর চোখ থেকে যোজন যোজন দূরে। পড়ে থাকল কেবলই হাজারো স্মৃতি আর বেদনা।
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম। তার মরদেহ আজ মঙ্গলবার রাজশাহীতে দাফন করা হয়েছে। বিকেলে নগরের সপুরা গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
জানাজার আগে তৌকিরের জীবনী পড়ে শোনানো হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন তৌকিরের বাবা তহুরুল ইসলাম। বলেন, ‘আমি সেই হতভাগ্য পিতা, যে নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছি।’
পরিবারের সদস্যরা জানায়, ছোটবেলা থেকে আকাশের বুকে বীরদর্পে ওড়ার স্বপ্ন নিয়েই বড় হয়েছিলেন তৌকির ইসলাম। রাজশাহীর সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর ভর্তি হন ক্যাডেট কোচিংয়ে। স্বপ্ন পূরণের প্রথমধাপেই জয়ী হয়ে ২০১৭ সালে পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন তৌকির। সেখান থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই যোগ দেন বিমান বাহিনীতে।
তার কোচিংয়ের শিক্ষক হাবিবুর রহমান হাবীব বলেন, ‘ছোট থেকে তৌকিক অসম্ভব মেধাবী ও চৌকস ছিল। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই দুই বছর কোচিং করলে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল তৌকিরের বেলায়। মাত্র এক বছর কোচিং করেই সে পাবনা ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছিল। এমন মেধাবী ছেলে খুব কমই হয়। তার এমন মৃত্যুতে দেশ একজন চৌকস কর্মকর্তাকে হারালো।’
পরিবারের কাছেও মধ্যমণি ছিলেন পাইলট তৌকির। মাত্র বছরখানেক আগে বিয়ে করেন। রাজশাহী নগরীর উপশহরের ৩ নম্বর সেক্টরের ২২৩ নম্বর বাড়িটি ঘিরে জড়িয়ে আছে তৌকিরের হাজারো স্মৃতি। বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে শতশত মানুষ ভিড় জমান বাড়িটির সামনে। বুকচাপা কান্না আর শত বেদনার মাঝেও ঘুরফিরে তৌকির সম্পর্কে নানা কথাই বলছিলেন তার স্বজনরা।
নিহত তৌকিরের চাচা তাশদিকুল ইসলাম বলেন, ‘অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র ছিল তৌকির। বড়দের সম্মান আর ছোটদের স্নেহ করতো। ফাইটার বিমান চালানো তার দীর্ঘ দিনের শখ ছিল। কিন্তু কে জানত সেই বিমানই তার প্রাণটাও কেড়ে নেবে!’
তৌকিরের নানা আজিজুর রহমান বলেন, ‘ঢাকায় থাকলেও সে সবসময়ই পরিবারের খোঁজ খবর রাখত। কখন কার কী লাগবে, তা কিনে দিত। আমার কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছে তৌকির। কিন্তু এই অল্প বয়সে মারা যাবে তা আমরা কোনো দিনই ভাবিনি।’
এদিকে, আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে বিমান ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৌকিরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিমান ও সেনাবাহিনীর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জানাজায় আরও উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ, আরএমপি কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান, সাবেক সিটি মেয়র বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও রাজশাহী মহানগরী জামায়াতের আমির ড. কেরামত আলী। জানাজা শেষে নগরীর সপুরা গোরস্থানে তাকে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এর আগে আজ বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তৌকিরের মরদেহ রাজশাহীতে আনা হয়। প্রথমে মরদেহবাহী হেলিকপ্টারটি রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবতরণ করে। এরপর তার মরদেহ বিমান, সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কোয়ান্টম ফাউন্ডেশনের লাশবাহী গাড়ি নিয়ে নগরীর উপশহরে তিন নম্বর সেক্টরের তৌকির ইসলামের বাসায় যায়। সেখানে শত শত মানুষ চোখের জলে পাইলট তৌকির ইসলামকে শেষ বিদায় জানান।
এর আগে সোমবার ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় আজ সারাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।